ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম
ইসলামে সুন্দরভাবে কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইস্তেখারা নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন।নতুন কোন কাজ শুরু করার পূর্বে ভালো ফলাফলের আশায় ইস্তেখারা নামাজ আদায় করতে হয়। ইস্তেখারা অর্থ কল্যাণ প্রার্থনা করা। ইস্তেখারা নামাজের অর্থ হল কোন কাজের পূর্বে সে কাজের কল্যাণ প্রার্থনা করার আশায় নামাজ আদায় করা। কোন কাজ শুরু করার পূর্বে ওই কাজটির কল্যাণ লাভের আশায় আল্লাহর উদ্দেশ্য দুই রাকাত নামাজ ও দোয়া পড়ায় বিশেষ এই প্রার্থনাই হল ইস্তেখারা।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইস্তেখারা করার বিষয়ে হাদিসে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ইস্তেখারা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যেভাবে সকল কাজের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তেমনি প্রতিটি ভাল কাজের শুরুতে ইস্তেখারা করার শিখা দিয়েছেন। সাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি ইস্তেখারা সম্পর্কে বলেছেন-
" ওই ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না; যে আল্লাহর কাছে ইস্তেখারা বা কল্যাণ কামনা করে, মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার ওপর অটল অবিচল থাকে।"
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
" আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে পরামর্শ কর। এরপর আল্লাহর উপর ভরসা করে(সিদ্ধান্তে অটল থাকো)। নিশ্চয়ই আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে ভালোবাসেন"(সুরা আল ইমরানঃ আয়াত ১৫৯)
ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম
ইস্তেখারা প্রত্যেক মানুষের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর। ইস্তেখারা নামাজের কিছু নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হল-
- নামাজের পূর্বে উত্তমরূপে অজু করে নেওয়া।
- ইস্তেখারার উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা। এক্ষেত্রে সুরা ফাতিহার সঙ্গে যেকোনো সূরা মিলিয়ে পড়া।
- নামাজের সালাম ফেরানোর পর আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব ও মর্যাদার কথা মনে পড়ে একান্ত বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে দোয়া পড়া।
ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম ও দোয়া
নামাজের নিয়ম সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বেই জেনেছি এখন আমরা ইস্তেখারা নামাজের দোয়া সম্পর্কে জানব।
তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কোনো ভালো কাজের উদ্যোগ নেয়, তখন সে যেন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে। এরপর ইস্তেখারার নামাজের দোয়া পড়তে হবে-
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্তাখিরুকা বি ইলমিকা ওয়াস্তাগদিরুকা বি কুদরাতিকা; ওয়া আস আলুকা মিন ফাদলিকাল আজিম।ফাইকান্না তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু,ওয়া তা'লামু ওয়ালা আ'লামু;ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ুব। আল্লাহুম্মা ইঙ্কুন্তা তালামু আন্না হাজাল য়াম্রা(এখানে নিজের কাজের কথা মনে মনে উল্লেখ করতে হবে) খাইরুল লি ফি দিনি, ওয়া মাআসি ওয়া আকিবাতি আমরি(অথবা বলবে, আজিলি আমরি ওয়া আজিলিহি);ফাকদিরহু লি ওয়া আ-কি বাতি আমরি; ফাকদির হু লি ওয়া ইয়াসির হু লি, চুম্মা বারিকলি ওয়া ইন কুনতা কালামু আন্না হাজাল আমরা। শাররুল লি ফ্রি দিনি ওয়া মাআসি ওয়া আকিবাতি আমরি; ফাসরিফহু আ্ননি-ওয়াস ফিরমি আনহু, ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাই সু কানা সুম্মারদিনি বিহি"
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার জ্ঞানের সাহায্যে আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমি আপনার শক্তির সাহায্যে শক্তি ও আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। কেননা, আপনি ক্ষমতাবান; আমি ক্ষমতা রাখি না। আপনি জ্ঞান রাখেন, আমার জ্ঞান নেই এবং আপনি অদৃশ্য বিষয়ের সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত।
হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞানে আমার এ কাজ(নিজের প্রয়োজনের কাজ মনে মনে স্মরণ করবে) আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য(কিংবা বলবে দ্বীনদার জীবন জীবিকা ও কর্মের জন্য) কল্যাণকর হবে, আপনি তা আমার জন্য নির্ধারণ করে দিন। সেটা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তাতে বরকত দিন।
হে আল্লাহ! আর যদি আপনার জ্ঞানে আমার এ কাজ আমার দ্বীনদারী জীবন জীবিকা ও কর্মের পরিণামে(কিংবা, আমার বর্তমান ভবিষ্যতের জন্য) অকল্যাণকর হয়, তবে আপনি আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে দিন এবং সেটাকেও আমার থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আমার জন্য সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ নির্ধারণ করে রাখুন এবং আমাকে সেটার প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন।(বুখারী, হাদিসঃ 6382-6841, তিরমিজি, হাদিস: ৬৪৮)
সালাতুল ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম।
হাদিস বিশারদ ইবনে হাজার(রাঃ) ব্যাখ্যা করেছেন-ইস্তেখারা করা মানে কোন বিষয় বাছাই এবং নির্বাচন করার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। ইস্তেখারার উদ্দেশ্য হল কোন ব্যক্তিকে যদি দুইটি বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় বাছাই করে নিতে হয় সে যেন উত্তমটি বাছাই করে নেয় সে প্রার্থনা করা।
তিনি আরো বলেন-ইস্তেখারার গণ্ডি শুধুমাত্র'মুবাহ'(করলে অসুবিধা নেই এমন) বিষয়ের ক্ষেত্রে এবং এমন মোস্তাহাব এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, যে মুস্তাহাব অপর একটি মুস্তাহাবের সঙ্গে সংঘর্ষিক; সুতরাং দুইটির কোনটি আগে পালন করবে কিংবা কোনটি বাদ দিয়ে কোনটি পালন করবে সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অবশ্য ইস্তেখারা বড় ছোট সব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ অনেক ছোট ছোট বিষয়ের উপর অনেক বড় বিষয় নির্ভর করে।
ইস্তেখারা নামাজের করণীয়
- ছোট বড় যে কোন কাজের পূর্বে ইস্তেখারা করার অভ্যাস গড়ে তোলা সুন্নত.
- ইস্তেখার প্রতি দীর্ঘ বিশ্বাস রাখা। অর্থাৎ আল্লাহ আপনাকে যে কাজেরই তৌফিক দিয়েছেন তাতেই কল্যাণ নিহিত আছে এমন বিশ্বাস মনে দীর্ঘ ভাবে স্থির করা এবং আল্লাহর মহত্ব এবং বড়ত্বের কথা স্মরণ করা।
- ইস্তেখারা নামাজের বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করা।
- অন্যান্য যে সময়ে নফল নামাজ আদায় করার নিষিদ্ধ সময় সেই সময়ে ইস্তেখারা নামাজ পড়া নিষিদ্ধ।
- নারীদের ঋতুস্রাব বা সন্তান প্রসব জনিত রক্ত প্রবাহের সময়ে ইস্তেখারা নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকা উচিত। উক্ত সময়ে নারীদের ইস্তেখার প্রয়োজন হলে উত্তম রূপে অজু করে ইস্তেখারা নিয়েতে শুধু দোয়া পড়তে পারেন।
- ইফতেখার দোয়া মুখস্ত না থাকলে দেখে পড়া যায়।
- ইস্তেখারা করার পর নির্ধারিত বিষয়ের উপর স্বপ্ন দেখা আবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে স্বপ্নের মাধ্যমে যেমন সঠিক জিনিসটি জানার সুযোগ রয়েছে আবার নির্ধারিত বিষয়টির উপর মনের ঝোঁক বা আগ্রহ ইস্তেখারা কল্যাণের ইঙ্গিত দেয়।
- দুইটি জিনিসের মধ্যে যেটির উপর মনের ঝোঁক বা আগ্রহ বেশি থাকবে সেটিকে ইস্তেখারা ইঙ্গিত হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত।
- নামাজ আদায় করার পরও যদি সঠিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছাতে পারেন তাহলে একাধিকবার ইস্তেখারার নামায পড়া যায়।
- ইস্তেখার নিয়তে নামাজ এবং দোয়ার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি নিয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সৎ এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করা অতি উত্তম।
- যার কাজ তাকেই ইস্তেখার নামাজ পড়তে হবে। একজনের পক্ষে অন্যজনের জন্য ইস্তেখারা নামাজ এবং দোয়া পড়া সঠিক নয়।
বিয়ের জন্য ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম
বিয়ে মানুষের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ইসলামে সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কারণ চরিত্রকে হেফাজতে রাখার জন্য এবং যাবতীয় অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং দ্বীনী কাজ করার সহজ এবং সবথেকে উত্তম উপায় হল বিয়ে করা। সুশৃংখল এবং প্রশান্তিময় জীবনের জন্য বিয়ের বিকল্প নেই।
আল্লাহ তা'আলা বলেন-
" আর তার নির্দেশনা বলির মধ্যে এটি একটি যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন।তোমাদের সঙ্গিনীকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি লাভ করতে পারো এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা এবং দয়া সৃষ্টি করেছেন।নিশ্চয়ই এতে বহু নিদর্শন রয়েছে,সেইসব লোকের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে(সূরা রুমঃ২১)"
বিয়ের ক্ষেত্রে ইস্তেখারা নামাজ আদায় করা ভালো একটি আমল। শরীয়ত অনুযায়ী যে কোন ধরনের বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এলে প্রথমে ইস্তেখারা করতে হয়। আর বিয়ে হল আমাদের জীবনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ বিষয়ে নবীজির ইস্তেখারা করতে বলেছেন। এ বিষয়ে প্রিয় সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী রাদিয়াল্লাহুকে তার বিয়ের বিষয়ে কিভাবে ইস্তেখারা করতে হয় তা শিখিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন-প্রথমে তোমরা প্রস্তাব গোপন রাখো। এরপর উত্তম রূপে অজু করো এবং যে কয় রাকাত সম্ভব নামাজ আদায় কর, এরপর আল্লাহর প্রশংসা করে বল-
অর্থঃ হে আল্লাহ!আপনি সক্ষম আমি অক্ষম।আপনি জানেন আমি জানিনা।আপনি গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়ে সম্মুখ অবগত।আপনি যদি অমুককে(পাত্রীর নাম নিবে)আমার দিন দুনিয়া এবং আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর মনে করেন তাহলে তাকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আর যদি তার থেকে অন্য কেউ আমার দিন দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর হয় তাহলে আমার জন্য তাই ফয়সালা করুন।(সহিহ ইবনে হিব্বানাঃ৪০৪০)
শেষ কথা
আল্লাহতালা মুসলিম উম্মত সমূহের যথাযথভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ইস্তেখার নামাজ ও দোয়া পড়ার তৌফিক দান করুন। কুরআন এবং সুন্নাহর আমল অনুযায়ী নতুন কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।